আমার গল্প-মারজান আহমদ চৌধুরী

 আমার গল্প-

মারজান আহমদ চৌধুরী


আমার একজন নানা ছিলেন। আম্মার কিছুটা দুরসম্পর্কের চাচা। আলিম পরীক্ষা দেয়ার আগে নানাবাড়িতে তাঁর সাথে দেখা হয়েছিল। তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, এরপর কোথায় লেখাপড়া করতে চাও? আমি বলেছিলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি বললেন, যদি চান্স না পাও? আমি বললাম, তবুও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি আবারও জিজ্ঞেস করলেন, যদি ওখানে চান্স না পাও তাহলে কোথায় পড়বে? আমি শক্ত গলায় বললাম, তবুও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন তিনি বলেছিলেন, এরকম জেদ থাকলে চান্স না পেয়ে তো উপায়ই নেই। 

আমি ছোটবেলা থেকেই কচ্ছপ প্রকৃতির মানুষ। যেটি ধরি সেটি করেই দম নেই। যত কষ্ট হোক, আমি কখনও কোনোকিছু মাঝপথে ছেড়ে দেই না। ক্লাস থ্রি-তে পড়ার সময় আমাকে বলা হলো, স্কুলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আমাকে বক্তৃতা দিতে হবে। বক্তৃতাটি ইংরেজি ভাষায়, তাও আবার না দেখে। একজন শিক্ষক সেটি লিখে দিলেন এবং আমি না বুঝেই পুরো বক্তৃতা মুখস্থ করলাম। কিন্তু ডায়াসে দাঁড়ানোমাত্র মাথা-মগজ শূন্য হয়ে গেল। লক্ষ্য করলাম শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হচ্ছে। কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম মনে নেই, কিন্তু ডায়াস ছাড়িনি। এক সময় প্রিন্সিপাল মহোদয় কানে কানে বললেন, কাগজটি সাথে আছে? বললাম, জ্বি, পকেটে আছে। তিনি বললেন, বের করে দেখে দেখে পড়ে নাও। এই ছিল জীবনের প্রথম বক্তৃতা দেয়ার অভিজ্ঞতা, যেখানে কথার চেয়ে কাঁপার মাত্রা বেশি ছিল। শুনেছিলাম, একবার এক লোক গেছে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে। রুমে ঢুকার পরই সে থরথর করে কাঁপতে শুরু করল। ইন্টারভিউ বোর্ডের চেয়ারম্যান জিজ্ঞেস করলেন, বাবা তুমি এত কাঁপছ কেন? লোকটি বলল, স্যার কাঁপাকাঁপির কী দেখেছেন? একটা প্রশ্ন করে দেখুন কাঁপুন কারে কয়! 

ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় শখ জাগল কুরআন শরীফ হিফয করব। দাদা খুবই খুশি হলেন। কিন্তু এক নিকটস্থ অভিভাবক বললেন, “হিফয করার চিন্তা বাদ দিয়ে দাও। হিফযের জন্য চিকন কণ্ঠ থাকতে হয়। তোমার কণ্ঠ মোটা।” আল্লাহর শুকরিয়া, আমার চামড়া গণ্ডারের মতো শক্ত। অপমানে কষ্ট পাই, কিন্তু গায়ে লাগিয়ে রাখি না। দু'বছরে হিফয সম্পন্ন হলো। ওদিকে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধে মাদরাসা থেকে বহিষ্কার হওয়ার নোটিশ পেলাম। দোষ আমারই ছিল। তাই বহিষ্কার হওয়ার আগে নিজেই মাদরাসা ছেড়ে চলে এসেছিলাম। 

ক্লাস নাইনে পড়ার সময় আমাদের ক্লাসে গণিত প্রতিযোগিতা হয়েছিল। প্রতিযোগিতায় ১ম হয়েছিল আমার চাচাতো ভাই সাফওয়ান, আমি হয়েছিলাম ২য়। কিন্তু পুরস্কার বিতরণীর সময় দেখা গেল ১ম পুরস্কারে আমার নাম লেখা। গণিতের স্যারকে জানালাম। তিনি বললেন, দেখ মারজান, ক্লাসে তোমার রোল এক, সাফওয়ানের রোল চার। তাই তোমাকে ১ম পুরস্কার দেয়া হচ্ছে, সাফওয়ান পাবে ২য় পুরস্কার। সেদিনও বিষয়টি আমার কাছে তীব্র অন্যায় মনে হয়েছিল, আজও মনে হয়। ওই শিক্ষকের প্রতি আমার বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাবোধ বাকি নেই। সাফওয়ান এখনও আমাকে খোঁচা দিয়ে বলে, আমি কিন্তু ১ম হয়েছিলাম। 

২০১২-১৩ সেশনে ভর্তি হলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে। এর পরের সাড়ে পাঁচ বছর ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। ঢাবি ক্যাম্পাসে হেটে হেটে আমি প্রথমবার দুনিয়া দেখেছি, মানুষ দেখেছি, মানুষ চিনেছি। ভর্তি চলাকালীন প্রথমদিন দেখা গেল আমার এডমিট কার্ডে একটি ভুল আছে। শুধরানোর জন্য আমাদের বিভাগের অফিসে গিয়ে দেখি অফিস খালি। ঢুকলাম বিভাগীয় চেয়ারম্যানের রুমে। দেখি শার্টপ্যান্ট পরা এক ভদ্রলোক একটি চেয়ারে বসে কী যেন খুঁজছেন। আমি বিনয়ের সাথে বললাম, স্যার আমার একটি সমস্যা হয়েছে। উনি আমার কাগজপত্র দেখে ভুল শুধরানোর উপায় বলে দিলেন। এরপর খানিকটা ঝাড়ি দিয়ে বললেন, আমাকে স্যার ডাকবেন না, ভাই ডাকবেন। আমি আবেগে একেবারে গদগদ হয়ে গিয়েছিলাম। বিভাগের চেয়ারম্যান স্যার আমাকে 'ভাই' ডাকতে বলছেন! একজন অধ্যাপককে কীভাবে ভাই ডাকব? পরে জানলাম উনি বিভাগের চেয়ারম্যান নন, বিভাগের দপ্তরি মুন্না ভাই। কি এক বিড়ম্বনা! শুনেছিলাম, একবার এক অধ্যাপক একটি এলাকায় গেছেন পরীক্ষা নিতে। সেখানে গিয়ে তিনি শুনলেন, লোকে বলাবলি করছে, আমাদের এলাকাটি এক সময় ভালো ছিল। কিন্তু যখন ইসলাম গেছে, তখন শান্তিও চলে গেছে। অধ্যাপক খুশি হলেন। যাক, এরা তাহলে বুঝতে পেরেছে যে, ইসলাম না থাকার কারণে আজ এলাকায় শান্তি নেই। পরে খোঁজ নিয়ে জানলেন, ব্যাপারটি সেরকম নয়। কিছুদিন আগে ইসলাম উদ্দীন নামে ওই এলাকার এক লোক শান্তি বেগম নামক এক বিবাহিত মহিলাকে নিয়ে পালিয়ে গেছে। লোকে সেটিই বলাবলি করছিল!
বি.দ্রঃ সেদিনকার ঘটনার পর থেকে মুন্না ভাইয়ের সাথে আমার বেশ খাতির। আজ অবধি আমরা একে অন্যের খোঁজখবর রাখি। 

ক্লাস শুরু হওয়ার কিছুদিন পরই শুনা গেল ক্লাসে CR (ক্লাস প্রতিনিধি) নির্বাচন হবে। ঢাবি গণতান্ত্রিক জায়গা, তাই ওখানে সবকিছু হয় গণতান্ত্রিকভাবে। নির্বাচনে দাঁড়াল ৬ জন, তার মধ্যে ৩ জন আমাকে ক্যান্টিনে খাইয়েছিল তাদেরকে ভোট দেয়ার জন্য। বাংলাদেশের নির্বাচনী অঙ্গনে এটিই আমার প্রথম এবং শেষ খাওয়া। 

প্রথমদিকে আমি বাসা থেকে বাইসাইকেল চালিয়ে ক্যাম্পাসে আসা-যাওয়া করতাম। প্রায় সময় রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের মিছিলের মধ্যে পড়ে যেতাম। তারা গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিত, জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো। আমি মনে মনে বলতাম, ঢালো ঢালো পানি ঢালো। বামপন্থীরা বলত, একটাই মন্ত্র সমাজতন্ত্র। তাদের সেই সমাজতন্ত্র আজও কায়েম হয়নি। মাঝখানে যখন তাদের দুই আদর্শিক নেতা ইনু এবং মেনন হজে গিয়েছিলেন, তখন বেচারা বামপন্থীদের মুখ কালো হয়ে গিয়েছিল। 

৩য় বর্ষের শুরুতে হলে উঠলাম। আমাদের বিজয় একাত্তর হল এক কথায় রাজকীয় প্রাসাদ। পদ্মা বিল্ডিং-এর পাঁচ তলায় ৫০০২ নম্বর রুমে থাকতাম। ঢাকার অবাসযোগ্য ঘিঞ্জি পরিবেশের মধ্যে আমাদের ক্যাম্পাস এক টুকরো সবুজ উদ্যান। একদিন ক্যান্টিনে খেতে যাচ্ছি, এমন সময় হলের একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী আমাকে আটকালেন। বললেন, মামা বড় সমস্যায় পড়েছি। আপনি আমাকে একটু সাহায্য করুন। ভাবলাম টাকাপয়সার অভাবে পড়েছেন হয়তো। কিন্তু তিনি বললেন, বুঝলেন মামা, গত পরশু রাতে স্ত্রীর সাথে ঝগড়া হয়ে গেছে। এখন তাকে কিছুতেই মানাতে পারছি না। কী করব বলুন? আমি হেসে বললাম, আজ বাসায় যাওয়ার সময় এক প্যাকেট মিস্টি আর দুইটা গোলাপ ফুল নিয়ে যাবেন। কাজ হয়ে যাবে। পরদিন তিনি আমার রুমে হাজির, হাতে এক কাপ কফি। বললেন, মামা আপনার ফর্মুলা কাজ দিয়েছে। বললাম, মাশা আল্লাহ, কিন্তু কফি কেন? বললেন, শখ করে আনছি মামা, খেয়ে নিন। 

সাড়ে পাঁচ বছর ক্লাসে বসে শিক্ষকদের লেকচার শুনেছি। কারণে অকারণে রুমে গিয়ে তাঁদেরকে বিরক্ত করেছি। কিন্তু কেউ কখনও অপমান করে তাড়িয়ে দেননি। পলাশী, চানখারপুল, মল চত্বর, বটতলায় বসে বন্ধুদের সাথে দুনিয়ার সব বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেছি। ক্লাসের লেকচার থেকে ওই আড্ডাগুলো আমাকে অনেক বেশি শিখিয়েছে। আমি বড় হয়েছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কল্যাণে। বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার পর যতবার ঢাকায় গিয়েছি, একবারও ক্যাম্পাস না দেখে ফেরত আসিনি। তবে আমার কাছে বিশ্ববিদ্যালয় মানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিল্ডিং নয়। আমার কাছে বিশ্ববিদ্যালয় মানে আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরা, আমার বন্ধুরা, ক্যাম্পাসের চা-ওয়ালারা, ক্যান্টিনের ছেলেরা, রেজিস্টার অফিসের বদমেজাজি কর্মকর্তারা, হলের পরিচ্ছন্নতাকর্মী এবং মুন্না ভাইয়ের মতো হৃদয়বান মানুষেরা। 

আজ আমার প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শততম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। আমার বিশ্বাস, শত সমস্যা, শত সমালোচনার মধ্যেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উত্তরোত্তর উন্নত হবে, জাতিকে পথ দেখাবে। এই বিশ্বাস আমাকে দিয়েছে আমার বিশ্ববিদ্যালয়।


Post a Comment

Previous Post Next Post